ভাষার মাসে ভাষা মতিনকে স্মরণ ----- দিলওয়ার হোসেন

 বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিস্মরণীয়। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি যে উত্তাল গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল সেই আন্দোলনই আমাদের জাতির ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছিল। সেই আন্দোলনে বরকত, রফিক, জব্বারসহ অন্য যাঁরা অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন সেই শহিদরাই পথ তৈরি করেছিলেন আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার। অনুপ্রেরণা তৈরি করেছিলেন জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ের।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মূল ভিত্তি গড়ে তুলেছে ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ সাল থেকে এ আন্দোলনের সূচনা হলেও তার সফল পরিনতি লাভ করে '৫২ র ২১ ফেব্রুয়ারিতে। সেই সাফল্য থেকেই বাঙালি পেয়েছে মুক্তিসংগ্রামের উজ্জীবনী শক্তি ও সাহস। এই ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলেই যে মুখটি মানুষটির মুখ বাঙালির সামনে উদ্ভাসিত হয় ওঠে তিনি আবদুল মতিন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর কর্ম, শ্রম, মেধা উদ্ভাবনী শক্তি প্রভৃতি অসাধারণ অবদানের জন্য ভাষা মতিন অভিধায় অভিষিক্ত হন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য।
আবদুল মতিন ভাষা আন্দোলনেই থেমে থাকেননি।তিনি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে আমৃত্যু তিনি মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে অবিচল ছিলেন। তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল শোষণ, বৈষম্যহীন একটি মানবিক সমাজ। তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন , সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি অক্লান্তভাবে চেষ্টা করে গেছেন।কখনো মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি আপোষ করেননি। কোন পদ পদবী, অর্থ-বিত্তের প্রলোভন তাঁকে কখনো বিচলিত করতে পারেনি।
আবদুল মতিন জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯২৬ সালে ৩ ডিসেম্বর, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার শৈলজানা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আবদুল জলিল এবং মাতার নাম আমেনা খাতুন। তাঁর পিতা দার্জিলিং-এ চাকরি করতেন। গ্রামে আবদুল জলিলের বাড়ি ও বেশ জমাজমি ছিল। কিন্তু ১৯৩০ সালে যমুনা নদীতে তাদের বাড়িঘর, জমি ভেঙ্গে গেলে আবদুল জলিল পরিবারকে দার্জিলিং নিয়ে যান। সেখানে তিনি মহারানী বিলিকা বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে আবদুল মতিনের ৮ বছর বয়সে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন।
আবদুল মতিন ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে আই এ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ ভর্তি হন। এখানে উল্লেখ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে তিনি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পদে চাকরি পান। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে চাকরি না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি এ এবং ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনে এম এ পাস করেন।
বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যারা দাবী জানিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম নায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় যে সভায় তাঁর ভাষণে বলেছিলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।সে সভায় কয়েকজন ছাত্র no, no বলেন। আবদুল মতিন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৯৫২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আবদুল মতিন। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়কও ছিলেন তিনি। তাঁর সভাপতিত্বে আমতলার ছাত্র সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনের সময় আবদুল মতিন কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না, তবে কমিউনিস্টদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ভাষা আন্দোলনের সফল পরিনতির পর ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।পরের বছর তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সময় তিনি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে এশিয়া অঞ্চলের ছাত্র নেতাদের সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা রাষ্ট্র ভাষার দাবি করেন।এরপর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৬৭ সালে পার্টিতে মস্কো পিকিং দ্বন্দ্বে পার্টি বিভক্ত হলে তিনি চীনপন্থীদের দলে অবস্থান নেন। তিনি কৃষক সমিতিরও নেতা ছিলেন।তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে ১০ বছর জেলে এবং ১১ বছরের বেশি সময় আত্মগোপনে থাকেন।
অনেক ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে শেষ বয়সে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকেন। এই সংগ্রামী মানুষটি আজীবন আত্মত্যাগের মাঝে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর কোন বাড়ি,গাড়ি, জমি, টাকা কিছুই ছিলো না। দুই মেয়ের বাসায় তাঁর শেষ জীবন কেটেছে। তিনি ২০১৪ সালে ৮ অক্টোবর ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এই মহান মানুষটির স্মৃতির প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা।

Comments

Popular posts from this blog

নিদ্রিতার প্রতি - মুশফিক বরাত

নিদ্রিতাঃ জিরো জিরো সিক্স আবারো - মুশফিক বরাত

ছেলেটির নাম আগুন - মুশফিক বরাত