ঋত্বিক সাম্যবাদী বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত ---- দিলওয়ার হোসেন

মানবিকতায় উজ্জ্বল এক ঋষী ও সাম্যবাদী আদর্শে ভাস্মর মানুষ রণেশ দাশগুপ্ত।আমাদের কৈশোর থেকে তিনি আমাদের চৈতন্যে উজ্জ্বল ত্যাগী এক মহান পুরুষ।সারা জীবন মানবমুক্তির তপষ্যায় নিমগ্ন ছিলেন।তাই অনেকেই তাঁকে বলেন বিপ্লবী সন্ত। ৮৫ বছরের জীবনের ৭৫ বছরই তিনি সাম্য -স্বাধীনতার জন্য অবিরল সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সত্য,ন্যায় আর মানবমুক্তি ছিলো তাঁর সাধনা।

তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত এক অসাধারণ মানুষ।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান করে স্বাধীনতা লড়াই দিয়ে যে বিপ্লবী জীবনের শুরু তা অক্ষুণ্ণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়েও।বাঙালির ছয় দশকের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। মানবমুক্তির অন্বেষায় যেখানে যা কিছু ভালো তা একাগ্র চিত্তে আহরণ করেছেন।
মানব মুক্তির জন্য রাজনীতি আর সাহিত্য সাধনাকে বেছে নিয়েছিলেন পথ হিসেবে। সাহিত্য সাধনায় পরম আন্তরিকতায়, অকল্পনীয় নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিশীল ভাণ্ডার থেকে আহরণ করেছেন শিল্প-সাহিত্যের নির্যাস। বাঙালির চৈতন্য জাগ্রত করার জন্য রেখে গেছেন অমূল্য অবদান।
তিনি রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতির কলুষ কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।তাঁর রাজনীতি ছিল সংগ্রামের মাধ্যমে সাধারণ, মেহনতি মানুষের দৈনন্দিন অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা,কাজ, শিক্ষা নিশ্চিত করা।সম্পদ আরোহণ ও সমবন্টনের জন্য সংগঠন গড়ে তোলা।দেশ ও সারা বিশ্বের মানবসমাজের মুক্তি সুনিশ্চিত করা।
রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর কিশোরকালেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবী অনুশীলন দলে।সেখান থেকে মার্কসবাদের শিক্ষা গ্রহন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন।তখন থেকে আর পেছন ফিরে তাকাননি।আমৃত্যু নিমগ্ন ছিলেন সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার সংগ্রামে।
রণেশ দাশগুপ্তের সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৯ সালে স্কুল ছাত্রাবস্হায়। তাঁর ছিল শ্মশ্রুমণ্ডিত আকর্ষনীয় চেহারা।কথা বলতেন স্পষ্ট করে শুদ্ধ ভাষায়।পোষাক ছিল খুব সাধারণ পাজামা,ফুল সার্ট,পায়ে স্পঞ্জের সেন্ডেল।একটা সর্বগ্রাসী আকর্ষণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে।
রণেশ দাশগুপ্ত ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি আসামের ডিব্রুগড়ে মাতামহের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতামহের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে। তিনি পেশায় ছিলেন ডাক্তার। তিনি ডিব্রুগড়ে সিভিল সার্জন পদে কর্মরত ছিলেন।
তাঁর পৈত্রিক নিবস ছিল বিক্রমপুরের লৌহজং থানার গাউপাড়া গ্রামে।তাঁর বাবা অপূর্ব দাশগুপ্ত ছিলেন ভারতের বিখ্যাত ফুটবলার।সেই সূত্রে তিনি ভারতীর সরকারের হিসাব বিভাগে একাউন্টটেন্ডের চাকরি করতেন। তাঁর পরিবার ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর। তাঁর পিতামহের এক ভাই বরিশালের ব্রজমহন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।তিনি বব্রহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পৌত্র কবি জীবনানন্দ দাশ।
তিনি ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।তিনি প্রতিনিয়ত মানুষের চেতনা, প্রতিবাদের ভাষাকে সম্প্রসারিত করেছেন।বাংলাদেশের সকল সংগ্রামে তিনি অগ্রনী ছিলেন।আমাদের মহান একুশের ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন।১৯৩৮-৪৮ সালে প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় রণেশ দাশগুপ্তের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান।তাঁর লেখা বরাবর মানুষকে শানিত করে।তাঁর আলো দিয়ে আলো জ্বালা, উপন্যাসের শিল্পরূপ, আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ,সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে, আত্মজিঞ্জাসা,ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম, মনেমনে,সেদিন সকালে ঢাকায়, কখনো চম্পা কখনো অতসী প্রভৃতি বাঙলা সাহিত্য অমূল্য রত্ন ভান্ডার।
মহান এই মানুষটি শেষপর্যন্ত দেশে থাকতে পারেননি।১৯৭৫ সালে তিনি ভারত চলে যেতে বাধ্য হন।১৯৯৭ সালে তিনি কোলকাতায় পরলোক গমন করেন।
রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Comments

Popular posts from this blog

নিদ্রিতার প্রতি - মুশফিক বরাত

নিদ্রিতাঃ জিরো জিরো সিক্স আবারো - মুশফিক বরাত

ছেলেটির নাম আগুন - মুশফিক বরাত