বাংলাদেশ এবং দৃশ্যমান ত্রিভুজ শক্তি --- মুশফিক বরাত

        ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন চলেছে বহুদিন। তারপর ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ। পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অংশে বিভক্তির জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের উপর অন্যায়-অবিচার ও অত্যাচার চাপিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলন ঘটে; জন্ম হয় নতুন একটি দেশের- নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে দেখা যাচ্ছে এতদিনে এদেশে ত্রিভুজ শক্তির নিষ্পেষণ দেখা দিয়েছে। স্পষ্ট এক ত্রিভুজ শক্তির শক্তিশালী অবস্থান দেখা যাচ্ছে। যার কবলে পিষ্ট হয়ে জনগণ মুক্তির পথ খুঁজছে। শক্তিগুলো হলো- আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। স্বাধীনতার পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ মজা দেখিয়েছে- জনগণের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। মেজর জিয়াউর রহমান তার পরই চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক ভঙ্গুর পুঁজিবাদ তাকেও এগুতে দেয়নি। স্বাধীনতার পরবর্তী পুঁজিবাদী বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অসংখ্য কলকারখানা ও শ্রমিকের জন্ম দিয়েছে। গার্মেন্টস শিল্প ও ঔষধ শিল্পে স্বাবলম্বী হয়েছে বাংলাদেশ। শেখ মুজিবর রহমানের হাত ধরে এদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা উপস্থিত হয়েছে।

এখন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলে নেওয়া উচিত। স্বাধীনতার ঠিক দু’বছরের মাথায় ১৯৭৩ সালের গোড়াতেই, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভিয়েতনামকে উপলক্ষ করে পরিচালিত বিক্ষোভ মিছিলের ওপর গুলিবর্ষিত হয় যাতে শ্রমিকশ্রেণীর শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত একটি শ্রমিক সংগঠনের আক্রমণে কালুরঘাটে অসংখ্য শ্রমিক হতাহত হয়। বিগত ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ বাড়বকুন্ডে অবস্থিত আর আর টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের উপর ব্যাপক হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল সরকারী হিশেব মতে ২২ জন। বেসরকারী সূত্রে, যাতে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। স্বাধীনতার ঘোষক শেখ মুজিবর রহমান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন এদেশের মানুষকে স্বস্তি দেবার জন্যে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন নি। যদিও প্রগতিশীল-বামপন্থী দলগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক চাপে মার্কিন অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যুদ্ধোত্তর আওয়ামী লীগ দেশীয় শিল্প ও ব্যাংক-বীমা দেশের হাতে নিয়ে এলেও বৃটিশ মার্কিন-শিল্প, ব্যাংক-বীমা ইত্যাদিকে জাতীয়করণের বাইরে রেখেছিল। নিজেদের একটি পলিসি মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক এমন কোনো দেশকে সাহায্য দেয়না যে দেশ বিদেশী স্বার্থকে জাতীয়করণ করে। বৃটিশ ও মার্কিন স্বার্থ, তাদের চা-বাগান (সিলেটের অধিকাংশ চা-বাগানের মালিক বৃটিশ), বীমা-ব্যাংক এবং পাটখাত আওয়ামী লীগ কেন তাৎক্ষণিক জাতীয়করণ করেনি তা থেকেই বুঝা যায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছিল।
বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। তারা আসার পর বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, পানি, সার ও জ্বালানি সংকট বেড়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার সময় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ শতাংশ। টিসিবিকে শক্তিশালী করা ও গণবণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারার জন্যে পরের ৪ বছরের মধ্যে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি খাদ্যপণ্যের উপর বেশি ঘটেছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত অনেক চাপের মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম দিকে কৃষিখাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ শতাংশ; ২০১২ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশ। এক মণ ধানের উৎপাদন খরচ যেখানে ৭৫০/৮০০ টাকা সেখানে কৃষক ধান বিক্রি করে পেয়েছে ৩৫০/৪০০ টাকা।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আবারো আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীর বিভিন্ন ক্যাসিনোতে অভিযান চালায়। ধারণা করা হচ্ছে, এসবের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা চালাচ্ছেন। এসব ক্যাসিনোতে নিয়মিত মদ-জুয়ার আড্ডা বসে।
দীর্ঘদিন পর ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিগত ১৩ বছরে তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রসঙ্গে আসা যাক। দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি- ক্ষমতার অপব্যবহার ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবাসহ সুশীল সমাজ আন্দোলন করেছে। এমনকি বামপন্থীরাও রাজপথে নেমেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিগত ৫০ বছরে পালাক্রমে দেশের এই হাল করেছে। যাতে আপামর জনসাধারণতো বটেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উপাচার্যরাও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। জাতীয় পার্টিও তাদের শাসনামলে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি।
ভারতীয় আগ্রাসনের কারণে আমাদের বোন ফেলানী হত্যা হয়েছে। সীমান্ত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কথা বললে লীগের নেতারা অপর সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জাতীয় বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেয়। বাংলাদেশের জাতীয় নেতাদের মধ্যে একমাত্র মাওলানা ভাসানীই প্রকৃত ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০২১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একটি বড় সাফল্য আছে। তা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তারপরও পুরোপুরি সফল হয়নি। শুরুতে কাদের মোল্লার ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল। সেই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে সরকার আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিল। এরপরে রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত করা হয়। দেশের সম্পদ সমবণ্টিত না হয়ে ৯৫ শতাংশের হাতে রয়েছে। মাত্র ৫ শতাংশ সম্পদের সুবিধা ভোগ করছে সাধারণ জনগণ। ফলে আপেক্ষিক দারিদ্র্য বাড়ছে।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার মতে, গত ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ভোট বাতিল করতে হবে। সরকার বাতিল করতে হবে, পার্লামেন্ট বাতিল করতে হবে। নেমে যেতে হবে সরকারকে। জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রবসহ বিএনপির অধিকাংশ নেতাদের এই হলো দাবি। এসব সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কমিউনিস্টরা কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি তিনটিই বুর্জোয়া দল। ফলে বিকল্প গড়ে তুলতে হবে। রাজনীতি বাঁচাতে হবে। বামপন্থীসহ দেশের আপামর জনসাধারণকে একত্রিত হয়ে দুঃশাসন হটাতে হবে।
এই হলো ত্রিভুজ শক্তির যাতাকল। যাকে আমি বলছি- Triangle Grinder Power. এই ট্রাইঅ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার পাওয়ারে পিষ্ট হতে হতে জনগণ মুক্তির পথ খুঁজছে। পথ বের হতে হতে লেগে যেতে পারে এক দশক এমনকি দুই দশক। তারপরও সমাজতন্ত্রীরা হাল ছেড়ে দেবে না। তারা সমাজের প্রগতিশীল অংশ কৃষক শ্রেণীকে নিয়ে এগিয়ে যাবে আরো কিছুটা পথ। তারপর বিপ্লব।
আওয়ামী লীগের এক এমপি সম্প্রতি গত হয়েছেন। তার আর্থিক চালচিত্র নিম্নরূপ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া সূত্রে জানা যায় যে, তিনি সি এল সি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড থেকে ঋণ নিয়েছেন ১,৫৭০ কোটি। তাছাড়া ঢাকা নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটি কোম্পানি, ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার, মাহিম রিয়েল এস্টেট, মাহিম ট্রেড লিংক ও মাইশা প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট থেকে যথাক্রমে ঋণ নিয়েছেন- ৩৭৮ কোটি, ৭৯ কোটি, ৩৮০ কোটি, ১১ কোটি ও ৬৫৬ কোটি টাকা। সর্বমোট ঋণের পরিমাণ হলো ৩,০৭৪ কোটি টাকা। যে দেশের মানুষ তিনবেলা অন্নের যোগান দিতে পারে না; এক কাপ চা বিক্রির জন্য ফুটপাতে ও রাস্তায় রাস্তায় বৃদ্ধ পিতা ঘোরে সেই দেশে ৩,০৭৪ কোটি টাকা ঋণখেলাপিবৃত্তী-ভাবা যায়! তিনি হলেন ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক। গত ৪ এপ্রিল তিনি ঋণের বোঝা নিয়ে মারা গেছেন। যা গিয়ে পড়লো বাংলাদেশ নামক দেশটির ঘাড়ে।
এখন ট্রাইঅ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার পাওয়ারের দ্বিতীয় শক্তি বিএনপির প্রসঙ্গে আসি। দলটি সর্বশেষ ক্ষমতায় এসেছিল ২০০১ সালে। দেশের মোট ভোটের ৪১.৪০% ভোট পড়েছিল তাদের ব্যালটে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ মোট ভোটের ৪০.০২% নিয়ে। তারপর কোণঠাসা হয়েছে বাংলাদেশ। ক্ষমতায় আসার পরপরই আড়াইহাজারের গ্রামে ব্যাপক তান্ডব চালায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। আড়াইহাজার থানায় সদাশাদী উচিৎপুরা ও আগুয়ানদি গ্রামের প্রায় এক হাজার নারী-পুরুষকে সংগঠিত করে বিএনপির স্থানীয় নেতারাসহ অন্যরা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত এক বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ে ১৮টি পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে। তাদের ঘর-দুয়ার, আসবাবপত্র, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, গোলায় ধানসহ বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা লুটপাট করেছে। (দৈনিক যুগান্তর, ২২/১২/২০০১) এক্ষেত্রে এক লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল এই যে, এসব কিছুই ঘটেছে পুলিশের উপস্থিতিতে, তাদের নাকের ডগায়।
এই তান্ডবের সময় তাদের হাতে ছিল পিস্তল, রিভলভার, বল্লম, ককটেল, জুইত্যা, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি। মুহূর্তের মধ্যে ককটেল ফাটিয়ে ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে তারা সমগ্র এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের সাত মে জোট সরকারের সময় নোয়াগাঁও এমএ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় আহসানউল্লাহ মাস্টারকে। অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ হত্যাকান্ড ঘটেছিল। আরো ঘটে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ইউনুস হত্যাকান্ড। অধ্যাপক ইউনুস মৌলবাদবিরোধী শিক্ষক আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিলেন। ময়মনসিংহ সিনেমা হলে গ্রেনেড হামলা ঘটে। ভারত থেকে বাংলাদেশের দশ ট্রাক অস্ত্র আমদানির ঘটনা অবশ্যই চাঞ্চল্যকর।
তাছাড়াও সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্মম অত্যাচার অনেককেই বাধ্য করে দেশ ত্যাগ করতে। অমানুষিক নিগ্রহের শিকার হয়ে অনেক হিন্দু ভারতে পালিয়ে যায়। কেউ কেউ আশ্রয় নেয় পশ্চিমবঙ্গে। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী পর্যন্ত শিবিরের কর্মী নিয়োগের পরিস্থিতি মানুষের মুখে মুখে রটে। দুর্নীতিতে টানা তিনবার হ্যাট্রিকের রেকর্ড এই জোট সরকারের আমলেই হয়েছিল। কুষ্টিয়ায় বিদ্যুতের জন্য গুলি করে কৃষক হত্যা করা হয়।
এমতাবস্থায় জাতীয় পার্টির দিকে নজর দেয়া যাক। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার দেশ পরিচালনাকে সামরিক একনায়কতন্ত্রের সাথে তুলনা করা হয়। ২০১৮ সালে রংপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। আর তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হিশেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একাদশ জাতীয় সংসদের। তার মৃত্যু হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে।
জিয়াউর রহমানের অমানবিক মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান জাতীয়তাবাদী দলের আব্দুস সাত্তার। সাত্তার সরকারকে ১৯৮২ সালে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করে এরশাদ। পরবর্তীতে স্বজনপ্রীতি, নারী কেলেঙ্কারি, নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগে এক রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনের মুখে তার সরকারের পতন ঘটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান প্রাক্তন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার চাপে এরশাদকে বন্দী করেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরপর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। ফলশ্রুতিতে এরশাদের কয়েক বছর জেল ও জরিমানাও হয়।
নূর হোসেনের মূল চেতনা ছিল স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক। স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে যিনি রাজপথে আন্দোলন করেছিলেন- শহীদ হয়েছিলেন। নব্বুইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সূচনায় ছাত্র নেতৃত্বই ছিল প্রধান। এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন জয়নাল, কাঞ্চন, জাফর, সেলিম, দীপালি, দেলোয়ার, কমরেড তাজুল, জিহাদ, ময়েজউদ্দিন, বসুনিয়া, ডা. মিলনসহ অনেকে। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত নাম। যারা বাঙালী সমাজের হৃদয়ে- মননে-অস্তিত্বে মিশে আছে। গল্প-কবিতা-গানে যাদের নাম বারবার উঠে আসে।
দেশ স্বাধীন হবার পরে আমাদের চেতনা ছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম। এদেশের সংবিধানেও যা উল্লেখ আছে। ৯০’র স্বৈরাচার পতনের পর নির্বাচনী সংস্কৃতির মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তাছাড়াও এদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের অনির্ভরযোগ্য শ্রেণীচরিত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্মোচিত হয়েছিল। ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ যত ধরণের বেসামরিক ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান ছিল তা ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত অবস্থায় ছিলনা যারা সবেমাত্র গড়ে উঠেছিল। দেশকে আমলাদের হাতে তুলে দেবার জন্য ছিল প্রেসিডেন্টের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার ছিল তার প্রতিদিনের পরিকল্পনা। সেসময় স্বৈরশাসনবিরোধী দুটি জোট গঠিত হয়। প্রথমটি ছিল কম শক্তিশালী ১৫ দল। দ্বিতীয়টি বেশি শক্তিশালী ৭ দল। ১৫ দলে ছিল আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাকশাল, সিপিবি, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণআজাদী লীগ প্রভৃতি। শক্তিশালী ৭ দলে ছিল বিএনপি, ইউপিপি, কমিউনিস্ট লীগ, জাতীয় লীগ প্রভৃতি। ১৫ দলীয় জোট ঘোষণা করে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে গণমিছিল বের হয়। পরদিন ছাত্র মিছিলে পুলিশ গুলি করে। জাফর, জয়নাল নিহত হয় ও সারাদেশে ১৪০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
বর্তমানে জাতীয় পার্টি তিন অংশে বিভক্ত। একটি মূলধারা এরশাদ (জি এম কাদের), দ্বিতীয়টি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আর তৃতীয়টি হলো বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ)। এই তিনটি অংশ যেকোনো মুহুর্তে একত্রিত হয়ে যেতে পারে। হয়ে উঠতে পারে পুনরায় একটি রাজনৈতিক দল। ফলে প্রকট হয়ে উঠবে ত্রিভুজ শক্তির দৌরাত্ম্য। তাই যেমন সাবধান থাকতে হবে বামদের তেমনি জনগণকেও।

Comments

Popular posts from this blog

নিদ্রিতার প্রতি - মুশফিক বরাত

নিদ্রিতাঃ জিরো জিরো সিক্স আবারো - মুশফিক বরাত

ছেলেটির নাম আগুন - মুশফিক বরাত