অণুগল্প

 কৌশলে কুপোকাত 

       --- প্রকাশ চন্দ্র রায়


মিতা'র কথা শুনে হাসতে হাসতে ঢলে পড়লো রীতা।
গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো এবার মিতা, রাগ করে বলল,
-:আর থাকবো না তোর কাছে চললাম। 
চট করে উঠে দাঁড়িয়ে 
মিতার হাত ধরে টেনে বসাতে বসাতে সান্ত্বনার সুরে বলল রীতা, 
-:অত চটছিস ক্যান? 
বললাম তো,সব সমস্যার 
সমাধান করে দেব আজকেই। 
কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আবার বসে পড়লো মিতা। 
মৃদু হেসে রীতা বলল, 
-:আবার বলতো,মূল সমস্যাটা কি তোর? 
চটে উঠে মিতা বলল, 
-:বললাম তো! সুজন একদম পাত্তা দিচ্ছে না আমাকে!
-; তুই ওকে ভালবাসিস? 
-; সেটা তো তুইও জানিস!ওকে ছাড়া বাঁচব না আমি,প্রায় কান্নার স্বরে বলল মিতা।
-:সুজন কি তোকে ভালবাসে? কৌতুহলি রীতার প্রশ্ন। 
-; ভালবাসে কিন্তু স্বীকার করতে চায় না,আর একদম কাছে ঘেঁষে না। 
-: ও,! তবে শোন,পুরনো পণ্ডিতগণ কি বলেছেন? 
-; কী ! 
"ধনুকধারী তীর ছুঁড়লে, 
কেউ মরে কেউ মরে না" 
বুদ্ধিমানে ছাড়লে বুদ্ধি, 
তার সামনে কেউ বাঁচে না"! 
-:রাখ তোর হেঁয়ালি! এবার সত্যি সত্যিই হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠল মিতা। কেঁদে কেঁদে যা বলল,তার মর্মার্থ দাঁড়ায়, একই পাড়ার সুদর্শন ছেলে সুজন, এম,এ পাশ করে আপাতত দুটো কোচিং সেন্টারে পড়াচ্ছে আর বিভিন্ন জায়গায় দরখাস্ত করে চলছে। একই পাড়ায় বাড়ী বিধায় অতিভদ্র,লাজুক,বিনয়ী ও ভীতু প্রকৃতির সুজনকে ভালবেসে প্রেম নিবেদন করেছে মিতা। সে প্রস্তাবে অসম্মতিজ্ঞাপন না করলেও বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশও করেনি সুজন কুমার,তবে ভাবসাবে সম্মতির আভাস ফুটে উঠেছে তার আচরণে। পক্ষান্তরে সুজনের মা সুশীলা দেবী স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন মিতার বাবা-মাকে, মিতাকে তিনি পুত্রবধূ করতে চান। সেইসূত্রেই দুই পরিবারের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়। মিতা'র একান্ত কামনা যে সুজন কুমার স্পষ্ট করেই কিছু বলুক বা আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ুক তার প্রেমে। সবকিছু জেনে শুনেও নির্বিকার সুজন কুমার, মা'কে বলে দিয়েছে, এখনই যেন ওসব প্রসঙ্গ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করে সে, আগে কর্মসংস্থান,তারপরে অন্যকিছু।  উত্তরে মা সুশীলা দেবী বলেছেন,
 :-কর্মসংস্থানের বিশেষ কি এমন দরকার তার। বেশকিছু জমি-জমাসহ প্রায় ভরপুর একটা সংসার রেখেই মারা গেছেন সুজনের বাবা,কাজেই,,।
-:আজ রাতের মধ্যেই তোর পা'য়ে এনে ফেলবো সুজনদা'কে,এরকম যাদুবিদ্যা জানা আছে আমার। তুই শুধু বাড়ী গিয়ে রন্টু আর ঝন্টুকে পাঠিয়ে দে আমার কাছে,তারপর দ্যাখ কি কান্ডটা করছি।
 রীতা'র দৃঢ় বক্তব্যে অনেকটা ভরসা পেলো মিতা,কারণ সে জানে তার চেয়ে অনেক বেশী সাহসী আর বুদ্ধিমতি রীতা। একই কলেজে, একই সাবজেক্ট নিয়ে অনার্সে পড়লেও,দু'জনার চরিত্র ও ব্যবহার আলাদা প্রকৃতির। রীতা চঞ্চলা,সাহসী এবং বুদ্ধিমতি, অপরপক্ষে মিতা শান্তশিষ্ট, ভীরু প্রকৃতির। দু'জনে কাকা'তো-জ্যাঠা'তো বোন হলেও পাড়ার মধ্যরাস্তার দু'ধারে দু'জনের বাড়ী। মিতা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রন্টু ও ঝন্টু চলে এলো রীতার কাছে। ওরা দুজন জমজ ভাই, পাড়ার সেরা পাতি মাস্তান-দুষ্ট দ্য গ্রেটস। ক্লাস এইটে পড়ে দুজনেই। মাস্তান হলেও রীতাকে গুরু মানে দুজনে, আর রীতার ভীষণ ভক্তও ওরা। তিনজন মিলে অনেক্ষণ ধরে কি-সব যুক্তিবুদ্ধি করে,হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে ফিরে গেল রন্টু-ঝন্টু।
বেলা তখন ডুবু ডুব প্রায়। কোচিং সেন্টারে ক্লাশ শেষ করে বাজারে একটু আধটু আড্ডা মারতে মারতেই রাত দশটা বেজে গেল সুজনের। বড় রাস্তা থেকে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় নামতেই ডানে এলাকার মহাশ্মশান। শ্মশান ঘেঁষেই শ্মশানকালী'র মন্ডপ। গতকালই মহা-ধুমধামে বাৎসরিক কালীপূজো হয়ে গেছে এখানে। চৌদ্দহাত লম্বা কালীমূর্তিকে দেখলে,দিনের বেলাতেই কেমন ভয় ভয় লাগে অনেকের, তার উপর সে আবার শ্মশানকালী। গতকাল অমাবস্যার রাত ছিল,ঘোর অন্ধকারে ঢাকা আজকের প্রতিপদের রাতটাও। শ্মশানের কাছে এসে চমকে উঠলো সুজন! কি ব্যাপার! কালীমন্ডপে বাতি নেই কেন! ঐ তো সামনে তাদের পাড়ায় বৈদ্যুতিক বাতির ঝলক দেখাই যাচ্ছে,পিছনেও বাজারের আলো জ্বলছে, অথচ কালীমন্ডপে আলো নেই! প্রতিরাতেই তো মন্ডপের বারান্দায় ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলে একটা, আজ জ্বলছে না কেন? তবে কি ফিউজ হয়ে গেছে বাল্বটা! নানাবিধ ভাবনা ভাবতে ভাবতে মহাশ্বশানের ধারঘেঁষে সামনে হাঁটছে সুজন।  কালকে শহরে যেতে হবে,চাকুরীর ভাইভা পরীক্ষা আছে। লিখিত পরীক্ষার রেজাল্টশীটে ৩ নং সিরিয়ালে উঠেছে নাম তার। খুবই আশা করছে সে ভাইভা টেস্টে টিকে গেলে হয়েই যাবে চাকুরীটা। ঝুপ করে একটা ঢিল এসে পড়লো সামনে তার,তারপরে পিছনে, ডানে বামে,আবার-আবার-আবার। অনবরত ঢিলের ঝড়ে দিশেহারা হয়ে কালী মন্ডপের বারান্দায় এসে লুকালো সুজন। আর তখন'ই নাকিসুরে গর্জে উঠলো কালীমাতা,
:- এ্যাঁই ব্যাঁটা বেঁয়াদব, তুঁই আঁমার লঁক্ষ্মী-স্বঁরস্বতী মেঁয়েকে অঁবজ্ঞা কঁরেছিস। কাঁলকে তোঁর ভাঁইভা পঁরীক্ষা আঁছে রেঁ, যঁদি চাঁকুরীটা পেঁতে চাঁস,তাঁহলে আঁমার মিঁতা মেঁয়েটার চঁরণধূঁলো নিঁয়ে যাঁস,নঁইলে তোঁর...
 কালীমাতার তর্জন-গর্জন শেষ না হতেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো সুজন। 
দপ করে জলে উঠলো বারান্দার বাল্ব, বাল্বের সুইচটা অন করে খিলখিল করে হেসে উঠলো রীতা । রাস্তার দু'পাশের ঝোপ-ঝাড় হতে ছুটে এলো দুষ্ট দ্য গ্রেটদ্বয়।
 :-চলো রে পালাই,কারা যেন আসছে এদিকেই।
রীতা'র কথার সাথে সাথেই পালিয়ে গেল ওরা, রীতাও ছুটলো ওদের পিছনে,মুখে তার দুষ্টমী'র হাসি।

Comments

Popular posts from this blog

নিদ্রিতার প্রতি - মুশফিক বরাত

নিদ্রিতাঃ জিরো জিরো সিক্স আবারো - মুশফিক বরাত

ছেলেটির নাম আগুন - মুশফিক বরাত